রাসূলﷺ এর পিতা ও মাতা

আমাদের নবী ﷺ এর পিতা আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব ও মা আমিনা বিনত ওয়াহব-এর ব্যাপারে আলিমদের মধ্যে তিনটি মতামত রয়েছে। একদলের মতে তাঁরা নাজাতপ্রাপ্ত। একদলের মতে তাঁরা নাজাতপ্রাপ্ত নন। তৃতীয় দল এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেন। আমি সেই দলের অন্তর্ভুক্ত, যারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মা-বাবাকে নাজাতপ্রাপ্ত মনে করেন। 


রাসূল ﷺ এর মা-বাবাকে নাজাতপ্রাপ্ত মনে করার পেছনে আমাদের মুল দলিল হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত একটি মূলনীতি। রাসূল ﷺ এর মা-বাবা এমন এক যুগে, এমন এক জনপদের অধিবাসী ছিলেন, যেখানে কোনো রাসূল ছিলেন না। ইসমাঈল আলাইহিস সালামের পর কয়েক হাজার বছর মক্কায় কোনো রাসূল আসেননি। আল্লাহ বলেছেন-

وَمَا آتَيْنَاهُم مِّن كُتُبٍ يَدْرُسُونَهَا وَمَا أَرْسَلْنَا إِلَيْهِمْ قَبْلَكَ مِن نَّذِيرٍ

“আর আমি তাদেরকে কোনো কিতাব দেইনি যা তারা অধ্যয়ন করত। এবং আপনার পূর্বে তাদের কাছে কোনো সতর্ককারীও প্রেরণ করিনি।” [সুরা সাবা, ২২] 


রাসূল ﷺ এর ঠিক পূর্ববর্তী রাসূল ঈসা আলাইহিস সালাম প্রেরিত হয়েছিলেন য়ারুশালেম শহরে এবং তিনি রাসূল ﷺ এর আগমনের ৫৩৭ বছর পূর্বে বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যবর্তী এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতাকে ফাতরাত বা বিরতির যুগ বলা হয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন-

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ عَلَىٰ فَتْرَةٍ مِّنَ الرُّسُلِ أَن تَقُولُوا مَا جَاءَنَا مِن بَشِيرٍ وَلَا نَذِيرٍ فَقَدْ جَاءَكُم بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

“হে আহলে কিতাব! রাসূলদের আগমনের দীর্ঘ বিরতির পর তোমাদের কাছে আমার রাসূল এসেছেন, যিনি তোমাদেরকে (সবকিছু) স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছেন, যেন তোমরা বলতে না পারো যে, তোমাদের কাছে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী আসেনি। এখন তো তোমাদের কাছে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসেছেন। আর আল্লাহ সবকিছুর ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।” [সুরা মায়িদা, ১৯] 


রাসূল প্রেরণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের কাছে আল্লাহর পরিচয় দলিলসহ উপস্থাপন করা। আল্লাহ বলেছেন-

رُّسُلاً مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلاَّ يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُل

“আমি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলদের পর মানুষের কাছে আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সুযোগ না থাকে।” [সুরা নিসা, ১৬৫] 


একইসাথে আল্লাহর আইন হচ্ছে, রাসূল প্রেরণ করার আগ পর্যন্ত আল্লাহ মানুষকে আযাব দেন না। আল্লাহ বলেছেন-

وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّىٰ نَبْعَثَ رَسُولًا

“আমি আযাব দেই না, যতক্ষণ না রাসূল প্রেরণ করি।” [সুরা ইসরা, ১৫] 


সুতরাং আমরা তাদেরকে জাহান্নামি মনে করি, যারা দ্বীনে ইবরাহীমকে বিকৃত করেছে, যারা আরবের মাটিতে শিরকের আমদানি করেছে এবং যারা তাদের অনুকরণ করেছে। কিন্তু কয়েক সহস্রাব্দ পর, কোনো রাসূলের উপস্থিতি ছাড়াই, ভাসাভাসাভাবেও যারা মিল্লাতে ইবরাহীমের ওপর টিকে রয়েছিল এবং যাদের মধ্যে শিরকের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাঁদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক মন্তব্য করা উচিৎ। হাদীসে এসেছে, কিয়ামাতের দিন ফাতরাতের যুগের লোকদের ঈমানের পরীক্ষা নেয়া হবে [মুসনাদে আহমাদ, ১৬৩০১]। এ ব্যাপারে বিপরীত মতাদর্শীরা বলেন, রাসূল ﷺ এর মা-বাবার কাছে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের শরীয়াহ পৌঁছেছিল। ওই শরীয়াতের ওপর তাঁদের জবাবদিহি হবে। অথচ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁদের চেয়ে বহু সহস্রাব্দ আগের। ততদিনে সেই শরীয়াহ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। পূর্বেকার কোনো রাসূলের শরীয়াহ এতদিন অক্ষত থাকেনি। আল্লাহ নিজে কুরআনকে হিফাজত করেছেন বিধায় আমাদের নবী ﷺ এর শরীয়াহ অক্ষত রয়েছে। অতএব রাসূল ﷺ এর মা-বাবাকে আমরা ফাতরাতের যুগের মানুষ বলে মনে করি। পূর্বেকার রাসূলের শরীয়াহ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় তাঁদের কাছে সঠিক দাওয়াত পৌঁছেনি। তবে তাঁদের জীবনাচারে শিরকের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং তাঁদের নামই সাক্ষ্য দিচ্ছে, তাঁরা মিল্লাতে ইবরাহীমের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। 


আল্লাহ তাঁর হাবীবকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার জন্য সর্বোত্তম পূর্বপুরুষদের বেছে নিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেছেন-

وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ

“সাজদাকারীদের মধ্যে আপনার স্থানান্তর।” [সুরা শু'আরা, ২১৯]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রা. বলেছেন, নবী ﷺ যাদের ঔরসের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে পৃথিবীতে এসেছেন, তারা ছিলেন সাজদাকারী। [তাফসীর কুরতুবী, খ. ১৩, পৃ. ১৪৪] 


যারা রাসূল ﷺ এর মা-বাবাকে 'নাজাতপ্রাপ্ত নন' বলেন, তাদের দলিল দুটি হাদীস। রাসূলুল্লাহ ﷺ জনৈক সাহাবিকে বলেছেন-

إِنَّ أَبِي وَأَبَاكَ فِي النَّارِ

“আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে।” [সহীহ মুসলিম, ৩৪৭]

আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-

اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أنْ أسْتَغْفِرَ لِأُمِّي فَلَمْ يَأْذَنْ لِي واسْتَأْذَنْتُهُ أنْ أزُورَ قَبْرَها فأذِنَ لِي

“আমি রবের কাছে আমার মায়ের জন্য ইস্তিগফার করতে চাইলাম, কিন্তু তিনি অনুমতি দেননি। আমি তাঁর কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলাম, আমার রব অনুমতি দিলেন।” [সহীহ মুসলিম, ৯৭৬] 


এ দুটি হাদীসের দ্বারা তারা রাসূল ﷺ এর মা-বাবাকে 'জাহান্নামি' বলেন। কিন্তু উক্ত হাদীসদ্বয় কুরআনের একটি মূলনীতির বিপরীত। তাই উলামায়ে কিরাম এগুলোর তা'ওয়ীল (ব্যাখ্যা) করে বলেন, প্রথম হাদীসে 'পিতা' দ্বারা আবদুল্লাহ নয়, বরং চাচা আবু তালিব উদ্দেশ্য। কারণ তিনি ইসলাম পেয়েও কবুল করেননি। আরবি ভাষায় والد (ওয়ালিদ) দ্বারা জন্মদাতা পিতা উদ্দেশ্য হলেও أَب (আব) দ্বারা পিতা, চাচা, দাদা সবাইকে বুঝায়। কুরআনে ইয়াকুব আলাইহিস সালামের পুত্ররা ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে أَب (আব) বলেছেন। অথচ ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তাঁদের দাদার ভাই। দ্বিতীয় হাদীসে রাসূল ﷺ তাঁর মায়ের জন্য ইস্তিগফার করার অনুমতি পাননি সত্য, কিন্তু মাকে সরাসরি 'জাহান্নামি' বলা হয়নি। জাহান্নামের ফায়সালা এত তুচ্ছ নয় যে, একটি 'খবরে ওয়াহিদ' হাদীসের ওপর যুক্তি ধরে সেই নারীকে 'জাহান্নামি' বলবেন, যার পাক রেহেম থেকে আল্লাহর হাবীব ﷺ ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। বরং রাসূল ﷺ এর মা-বাবাকে 'জাহান্নামি' বলার কারণে রাসূল ﷺ কষ্ট পেতে পারেন। আর আল্লাহ বলেছেন- 

إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِينًا 

“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের প্রতি দুনিয়া আখিরাতে আল্লাহর লা'নত। এবং তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” [সুরা আহযাব, ৫৭] 


আমরা আমাদের নবী ﷺ এর মা-বাবাকে নাজাতপ্রাপ্ত মনে করি। আল্লাহ আমাদের নবীকে ওয়াদা দিয়েছেন-

وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَىٰ

“অচিরেই আপনার রব আপনাকে এত (নিয়ামাত) দেবেন, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।” [সুরা আদ-দ্বোহা, ৫]

ইন শা আল্লাহ, আমাদের নবী ﷺ এর মা-বাবাকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে আল্লাহর সেই ওয়াদা পূর্ণ হবে। 


فداك أبي وأمي ونفسي وروحي يا رسول الله ❤️

Comments

Popular posts from this blog

দাঁড়ি ও মুসলিম